মোহিনী একাদশী হিন্দু ধর্মের অন্যতম পবিত্র একাদশী উপবাসের দিন, যা বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিতে পালিত হয়। এই একাদশীর নাম মোহিনী একাদশী হওয়ার কারণ হলো, এদিন ভগবান বিষ্ণু মোহিনী রূপ ধারণ করে দেবতাদের উদ্ধার করেছিলেন এবং অসুরদের ধোঁকা দিয়েছিলেন। তাই এই একাদশীকে মোহ ও মোহজাল থেকে মুক্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

মোহিনী একাদশী

মোহিনী একাদশীর মাহাত্ম্য ও পৌরাণিক কাহিনী

মোহিনী একাদশীর সাথে যুক্ত পৌরাণিক কাহিনীটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয়। সমুদ্র মন্থনের সময় দেবতা ও অসুরেরা একসাথে অমৃতের জন্য সংগ্রাম করছিল। যখন অমৃতের কুম্ভ বের হলো, তখন দেবতারা ভগবান বিষ্ণুকে সাহায্যের জন্য আহ্বান জানালেন। ভগবান বিষ্ণু তখন মোহিনী নামক এক সুন্দরী নারীর রূপ ধারণ করে অসুরদের কাছে অমৃতের কুম্ভ নিয়ে গেলেন।

মোহিনী রূপে বিষ্ণু অসুরদের এমনভাবে প্রলুব্ধ করলেন যে তারা অমৃত পান করতে ব্যর্থ হলো, এবং সেই অমৃত কুম্ভটি দেবতাদের হাতে তুলে দেওয়া হলো। এর ফলে দেবতারা অমৃত পান করে অমরত্ব লাভ করলেন, আর অসুরেরা খালি হাতে ফিরে গেল। এই ঘটনায় মোহিনী একাদশীর মাহাত্ম্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়, কারণ এই দিনটি মোহজাল থেকে মুক্তির এবং আত্মিক জাগরণের প্রতীক।

মোহিনী একাদশী পালন করার নিয়ম

মোহিনী একাদশী পালনের মাধ্যমে মানুষ তার জীবনে মোহ ও প্রলোভন থেকে মুক্তি পেতে পারে। এই একাদশীর উপবাস পালনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম রয়েছে:

উপবাসের প্রস্তুতি: একাদশীর আগের দিন সন্ধ্যা থেকে নিরামিষ আহার গ্রহণ করা উচিত এবং রাতে পরিমিত আহার করতে হবে। এই সময়ে মদ্যপান, ধূমপান এবং অন্যান্য অপবিত্র কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত।

ভগবান বিষ্ণুর পূজা: একাদশীর দিন সকালে স্নান করে ভগবান বিষ্ণুর মূর্তি বা ছবি সামনে রেখে পূজা করতে হয়। ধূপ, দীপ, ফুল, ফল, এবং তাম্বুল (পান পাতা) দিয়ে পূজা সম্পন্ন করতে হয়। বিশেষ করে তুলসী পাতা ভগবানকে নিবেদন করা উচিত, কারণ এটি বিষ্ণুর প্রিয়।

গীতা পাঠ ও মন্ত্র জপ: মোহিনী একাদশীর দিন ভগবদ্‌গীতা পাঠ ও ভগবান বিষ্ণুর মন্ত্র জপ করা অত্যন্ত ফলপ্রসূ। "ওম নমো ভগবতে বাসুদেবায়" মন্ত্রের জপ এই দিনে বিশেষ পুণ্য প্রদান করে।

অন্ন গ্রহণ থেকে বিরত থাকা: এই একাদশীর প্রধান নিয়ম হলো অন্ন গ্রহণ থেকে বিরত থাকা। তবে যাদের শারীরিক অসুবিধা রয়েছে তারা ফলমূল ও দুধ গ্রহণ করতে পারেন।

রাত্রি জাগরণ: একাদশীর রাতে ভগবান বিষ্ণুর নামগান, ভজন বা ধ্যানের মাধ্যমে জাগরণ পালন করা উচিত। এটি আত্মার শুদ্ধি এবং পুণ্য সঞ্চয়ে সহায়ক।

মোহিনী একাদশীর উপকারিতা

মোহিনী একাদশী পালনের মাধ্যমে মানুষ তার জীবনের মোহ ও প্রলোভন থেকে মুক্তি পায় এবং আত্মিক উন্নতি লাভ করে। এখানে মোহিনী একাদশীর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা উল্লেখ করা হলো:

মোহমুক্তি: এই একাদশী পালনের মাধ্যমে জীবনের সকল প্রকার মোহ, প্রলোভন ও ধোঁকা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এটি আত্মার শুদ্ধি ও মনের স্থিরতা আনে।

পাপমোচন: মোহিনী একাদশীর উপবাস পালন করলে জীবনের পাপমোচন হয় এবং মানুষ আত্মিক উন্নতি লাভ করে। এই উপবাস পাপের বিনাশ ঘটিয়ে পুণ্য সঞ্চয় করে।

সুখ-সমৃদ্ধি: মোহিনী একাদশী পালনের মাধ্যমে জীবনে সুখ, সমৃদ্ধি এবং মানসিক শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ভগবান বিষ্ণুর আশীর্বাদে সংসার জীবনে সাফল্য এনে দেয়।

মোহিনী একাদশী পালনের সময় কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ:

১. পূর্ণ ভক্তি ও নিষ্ঠা নিয়ে উপবাস পালন করুন:

মোহিনী একাদশীর উপবাস পূর্ণ ভক্তি ও নিষ্ঠার সাথে পালন করতে হবে। এটি শুধু শারীরিক ত্যাগ নয়, বরং মানসিক শুদ্ধির মাধ্যমও। এই উপবাস পালন করতে হলে মনকে শান্ত ও স্থির রাখতে হবে এবং ভগবান বিষ্ণুর প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখতে হবে।

২. শাস্ত্র পাঠ ও মন্ত্র জপ করুন:

এই দিনে গীতা, বিষ্ণু সাহস্রনাম ও অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থের পাঠ করা উচিত। মন্ত্র জপের মাধ্যমে আত্মিক শক্তি সঞ্চারিত হয় এবং মনকে প্রলোভন থেকে রক্ষা করা যায়।

৩. দান-ধর্মে অংশগ্রহণ:

মোহিনী একাদশীর দিনে দান-ধর্ম করা অত্যন্ত ফলপ্রসূ। দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তদের সাহায্য করা এবং তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করা উচিত। বিশেষত, খাবার ও বস্ত্র দান করা অত্যন্ত পুণ্যকর্ম।

৪. পরিবার ও সমাজের কল্যাণ কামনা:

মোহিনী একাদশীর উপবাস পালনকালে পরিবার, সমাজ এবং দেশের মঙ্গল কামনা করা উচিত। ভগবান বিষ্ণুর কাছে প্রার্থনা করুন, যাতে সকলের জীবনে সুখ, শান্তি এবং সমৃদ্ধি আসে।

মোহিনী একাদশী পালন করার ফলাফল

মোহিনী একাদশী পালনের মাধ্যমে ভক্তরা যে উপকার লাভ করতে পারেন, তা তাদের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। এই একাদশী পালন করলে পাপমুক্তি, মানসিক স্থিরতা, শারীরিক সুস্থতা এবং আত্মিক উন্নতি ঘটে।

১. পাপমোচন:

মোহিনী একাদশীর প্রধান মাহাত্ম্য হলো পাপমোচন। এই দিনটি পালন করলে পূর্বজন্মের এবং এই জীবনের সকল পাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। আত্মা শুদ্ধ হয় এবং ভগবানের আশীর্বাদে পুণ্য অর্জন করা যায়।

২. মোহমুক্তি ও মনোস্থিরতা:

মোহিনী একাদশী পালন করলে জীবনের সকল প্রকার মোহ ও প্রলোভন থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এটি মনকে স্থির করে এবং জীবনে ধৈর্য ও সহনশীলতা আনে।

৩. সংসার জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি:

এই একাদশীর পূজা ও উপবাস পালন করলে সংসার জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়। ভগবান বিষ্ণুর আশীর্বাদে সংসারের সব বাধা দূর হয় এবং সুখের আবহাওয়া সৃষ্টি হয়।

উপসংহার

মোহিনী একাদশী হলো পবিত্রতার প্রতীক, যা মোহমুক্তি এবং পুণ্যের সঞ্চয়ে সহায়ক। এই একাদশীর উপবাস ও পূজা পালনের মাধ্যমে মানুষ জীবনের সকল প্রকার প্রলোভন, মোহ এবং ধোঁকা থেকে মুক্তি পেতে পারে। আত্মিক উন্নতি, পাপমোচন এবং জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি লাভের জন্য মোহিনী

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন