হিন্দু ধর্ম হলো পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্মগুলির মধ্যে অন্যতম, যা ভারতের উপমহাদেশে হাজার হাজার বছর ধরে প্রচলিত রয়েছে। এই ধর্মের ইতিহাস, বিশ্বাস এবং প্রধান ভগবানের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল, যা হাজার বছরের প্রাচীন আচার-অনুষ্ঠান ও দর্শনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।

হিন্দু

হিন্দু ধর্মের উৎপত্তি

হিন্দু ধর্মের সৃষ্টির সঠিক সময় নির্ধারণ করা কঠিন, কারণ এটি কোনো একক প্রতিষ্ঠাতার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। হিন্দু ধর্ম একটি সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক ও সামাজিক বিশ্বাসের সমষ্টি, যা বহু শতাব্দীর মধ্যে বিকাশ লাভ করেছে। হিন্দু ধর্মের প্রথম ধাপ শুরু হয় বৈদিক যুগ থেকে। এই সময়ের প্রধান ধর্মগ্রন্থগুলি হলো বেদ, যা ঋষিরা শুনে শুনে মুখে মুখে প্রচার করতেন।

বেদের মধ্যে ঋগ্বেদ সবচেয়ে প্রাচীন, যা খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ১৫০০ থেকে ১২০০ বছরের মধ্যে রচিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। এই সময় থেকে হিন্দু ধর্মের মৌলিক বিশ্বাস, পূজা-পদ্ধতি, এবং আচার-অনুষ্ঠান গড়ে উঠতে শুরু করে। তবে, হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও উপ-শাখার উদ্ভব ও বিকাশের সাথে সাথে ধর্মটি আরও জটিল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

হিন্দু ধর্মের প্রধান স্রষ্টা

হিন্দু ধর্মের প্রধান স্রষ্টা বা ভগবান সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে, প্রথমেই যে নামটি আসে, তা হলো ভগবান ব্রহ্মা। ব্রহ্মা হলেন সৃষ্টিকর্তা, যিনি সমগ্র বিশ্বজগতের সৃষ্টি করেছেন। ব্রহ্মা হিন্দু ত্রিমূর্তির (ত্রিমূর্তি) অন্যতম প্রধান অংশ। ত্রিমূর্তির বাকি দুই সদস্য হলেন বিষ্ণু, যিনি রক্ষা করেন এবং মহাদেব শিব, যিনি ধ্বংসের মাধ্যমে নতুন সৃষ্টির পথ প্রশস্ত করেন।

তবে হিন্দু ধর্মের বৈচিত্র্যপূর্ণ বিশ্বাসের কারণে, ব্রহ্মার পাশাপাশি অন্যান্য দেবতা ও দেবীদেরও প্রধান স্রষ্টা হিসেবে মানা হয়। অনেক হিন্দু সম্প্রদায় প্রধান ভগবান হিসেবে বিষ্ণু, শিব বা শাক্তি (দুর্গা, কালী ইত্যাদি) কে পূজা করেন। প্রতিটি সম্প্রদায়ের বিশ্বাস ভিন্ন, এবং এই বৈচিত্র্য হিন্দু ধর্মকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।

সৃষ্টির মিথ ও কাহিনী

হিন্দু ধর্মে সৃষ্টির কাহিনী বিভিন্ন পুরাণে পাওয়া যায়। পুরাণগুলি হিন্দু ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ, যেখানে সৃষ্টির কাহিনী থেকে শুরু করে দেবতা ও মানব জাতির ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে।

ব্রহ্মাকে সৃষ্টির আদিকর্তা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বীজ রূপে আত্মার উদ্ভব করেন। এরপর ব্রহ্মা নিজেই নানা আকার ধারণ করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত জীবের সৃষ্টি করেন। ব্রহ্মার চারটি মাথা, চারটি বেদ ও চারটি দিকের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়।

অন্যান্য ভগবান ও দেবতা

হিন্দু ধর্মে একাধিক ভগবান ও দেবতার উল্লেখ আছে, যারা একেক জন একেক শক্তির প্রতীক। প্রধান ভগবানদের মধ্যে বিষ্ণু ও শিব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিষ্ণু হিন্দু ধর্মের পালনকর্তা হিসেবে পরিচিত, যিনি সকল জীবের রক্ষাকর্তা। শিব হলেন ধ্বংসের দেবতা, কিন্তু তিনি ধ্বংসের মাধ্যমে পুনর্জন্মের প্রক্রিয়াকেও নির্দেশ করেন।

শক্তি বা মাতৃশক্তি (দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী) হিন্দু ধর্মের নারী শক্তির প্রতীক। তারা ব্রহ্মাণ্ডের সকল শক্তির উত্স এবং তাদের পূজা প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত রয়েছে।

আরও পড়ুনঃ কৃষ্ণ ও বিষ্ণুর মধ্যে পার্থক্য: ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ

উপসংহার

হিন্দু ধর্মের সৃষ্টি ও প্রধান ভগবান সম্পর্কিত এই আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে হিন্দু ধর্ম একটি বহুমুখী ও বৈচিত্র্যপূর্ণ ধর্ম, যা বহু শতাব্দীর মধ্যে বিকাশ লাভ করেছে। প্রধান স্রষ্টা হিসেবে ব্রহ্মার উল্লেখ থাকলেও, হিন্দু ধর্মের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের কারণে, বিভিন্ন দেবতা ও দেবী প্রধান ভগবান হিসেবে মান্যতা পেয়েছেন। হিন্দু ধর্মের এই বৈচিত্র্য ও ঐতিহ্য ধর্মটিকে সমৃদ্ধ ও সুপ্রতিষ্ঠিত করে তুলেছে।

এটি বলাই যায় যে, হিন্দু ধর্ম কেবলমাত্র একটি ধর্ম নয়, এটি একটি জীবনদর্শন, যা মানুষের চিন্তা, বিশ্বাস ও আচার-আচরণের মাধ্যমে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বেঁচে রয়েছে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন