ষটতিলা একাদশী হিন্দু ধর্মের বিশেষ একাদশী উপবাসের দিন, যা ভগবান বিষ্ণুর প্রতি নিবেদিত। এই একাদশী পুণ্যের অমৃত সঞ্চয়ের বিশেষ দিন হিসেবে পরিচিত এবং হিন্দু ধর্মালম্বীদের জন্য অত্যন্ত পবিত্র ও তাৎপর্যপূর্ণ।
ষটতিলা একাদশী নামটি এসেছে "ষট" (ছয়) এবং "তিল" (তিল বা তিলের বীজ) এই দুটি শব্দের সমন্বয়ে। এই একাদশীতে ছয়টি উপায়ে তিল ব্যবহার করা হয়, যা ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। ছয়টি পদ্ধতি হলো—তিল দিয়ে স্নান, তিল দিয়ে তেল মাখানো, তিল দিয়ে হোম বা আগুনের পূজা করা, তিল খাওয়া, তিল দিয়ে দান করা এবং তিল দিয়ে পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ করা।
ষটতিলা একাদশীর ইতিহাস ও মাহাত্ম্য
ষটতিলা একাদশী সম্পর্কে কথিত আছে যে এক সময় দেবী পার্বতী ভগবান শিবের নিকট এসে জানতে চান, কোন উপবাস পালন করলে মানুষের সমস্ত পাপ মুক্তি পাবে এবং তারা স্বর্গে স্থান লাভ করবে। ভগবান শিব তখন তাকে ষটতিলা একাদশীর উপবাসের মাহাত্ম্য সম্পর্কে জানান।
এই উপবাসের মাধ্যমে মানুষ দারিদ্র্য, অসুখ ও পাপ থেকে মুক্তি পায়। যারা এই একাদশীর উপবাস পালন করেন, তারা পরলোক গমনের পর স্বর্গে সুখ ও সমৃদ্ধি ভোগ করেন। কথিত আছে যে এই একাদশীর উপবাস পিতৃপুরুষদের মুক্তি দেয় এবং পুণ্যের ফলাফল বহুগুণে বৃদ্ধি করে।
উপবাসের নিয়ম ও পদ্ধতি
ষটতিলা একাদশীর উপবাস শুরু হয় একাদশীর দিন সূর্যোদয়ের পর থেকে এবং এটি দ্বাদশীর দিন সূর্যোদয়ের পর পূর্ণ হয়। উপবাসের দিন সকালে পূজা অর্চনা করতে হয় এবং তিলের তেল দিয়ে স্নান করতে হয়। এরপর ভগবান বিষ্ণুর মূর্তি বা ছবি সামনে রেখে ধূপ, প্রদীপ, ফুল ও ফল দিয়ে পূজা করতে হয়। ভগবান বিষ্ণুর মন্ত্র জপ করা এবং "ওম নমো ভগবতে বাসুদেবায়" মন্ত্র পাঠ করা খুবই ফলপ্রসূ।
এই একাদশীতে তিলের মিশ্রণে তৈরি বিভিন্ন ভোগ নিবেদন করা হয়, যা ভগবান বিষ্ণুর প্রিয়। তিলের লাড্ডু, তিলের হালুয়া ইত্যাদি প্রস্তুত করে ভগবানকে নিবেদন করা হয় এবং তারপর সেই প্রসাদ ভক্তদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
ষটতিলা একাদশীর বিশেষ তাৎপর্য
এই একাদশীর মূল লক্ষ্য হলো আত্মশুদ্ধি এবং পুণ্যের সঞ্চয়। তিল দিয়ে স্নান ও তেল মাখানো শরীরের সমস্ত অশুদ্ধতা দূর করে এবং মন ও আত্মাকে পবিত্র করে। তিলের হোম বা আগুনে আহুতি প্রদান করা, তিল খাওয়া এবং দান করা স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন করে এবং পাপের নাশ ঘটায়।
পণ্ডিতদের মতে, এই একাদশীতে তিল দিয়ে পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ করা হলে তারা মুক্তিলাভ করেন এবং তাদের আত্মা শান্তি পায়। তিলের ব্যবহারে শারীরিক ও মানসিক শক্তি বৃদ্ধি পায়, যা মানুষকে জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে সাহায্য করে।
ষটতিলা একাদশী পালন করার উপকারিতা
ষটতিলা একাদশী পালন করার মাধ্যমে মানুষ তার জীবনে অনেক ধরনের উপকার পায়। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, এই একাদশীর উপবাস ও তিলের ব্যবহারে যে পুণ্য লাভ হয়, তা মানুষের জীবনে সুখ, সমৃদ্ধি ও শারীরিক সুস্থতা আনে। এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা উল্লেখ করা হলো:
১. পাপমোচন
ষটতিলা একাদশীর অন্যতম প্রধান উপকারিতা হলো পাপমোচন। বিশ্বাস করা হয়, যারা পূর্বের জীবনে বা এই জীবনে পাপ করে থাকেন, তারা এই একাদশীর উপবাস পালন করলে তাদের পাপ ধুয়ে মুছে যায়। বিশেষত, তিলের ব্যবহার পাপের বিনাশ ঘটায়।
২. দারিদ্র্য দূরীকরণ
ষটতিলা একাদশী পালন করলে দারিদ্র্য দূর হয় এবং জীবনে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসে। তিলের দান বিশেষভাবে এই একাদশীর মূল আচারগুলির মধ্যে একটি এবং এটি দারিদ্র্যের অবসান ঘটায় বলে মনে করা হয়। তিলের মাধ্যমে পিতৃপুরুষদের শ্রাদ্ধ করলে তাদের আশীর্বাদে পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটে।
৩. স্বাস্থ্যের উন্নতি
তিল একটি শক্তিশালী পুষ্টি উপাদান হিসেবে পরিচিত। তিল খাওয়ার মাধ্যমে শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের সরবরাহ হয়, যা শারীরিক সুস্থতা বৃদ্ধি করে। তিলের তেল ব্যবহার করলে ত্বকের স্বাস্থ্য ভালো হয় এবং শরীরে শক্তি আসে।
৪. আত্মশুদ্ধি
ষটতিলা একাদশীর প্রধান লক্ষ্য হলো আত্মশুদ্ধি। এই দিনে তিল দিয়ে স্নান ও তেল মাখানোর মাধ্যমে শরীর থেকে সমস্ত অশুদ্ধতা দূর হয়। তিলের হোম ও ধূপ প্রদানের মাধ্যমে বাড়ির পরিবেশ শুদ্ধ হয় এবং নেগেটিভ এনার্জি দূর হয়।
৫. পিতৃপুরুষদের মুক্তি
এই একাদশীর দিন পিতৃপুরুষদের শ্রাদ্ধ করা হলে তারা মুক্তিলাভ করেন এবং তাদের আত্মা শান্তি পায়। ফলে, পরিবারের সুখ ও সমৃদ্ধি বাড়ে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আশীর্বাদে উন্নতি লাভ করে।
ষটতিলা একাদশী পালন করার কিছু পরামর্শ
ষটতিলা একাদশীর উপবাস পালন করতে গেলে কিছু নিয়ম ও পরামর্শ মেনে চলা উচিত। এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দেওয়া হলো:
সকালবেলা তিলের তেল দিয়ে স্নান করুন: স্নানের পর ভগবান বিষ্ণুর পূজা করুন এবং মন্ত্র পাঠ করুন। স্নান করার সময় মনে রাখবেন যে এটি শুধু শারীরিক পরিশুদ্ধি নয়, মানসিক ও আত্মিক পরিশুদ্ধিও বটে।তিলের হোম ও ধূপ প্রদানের মাধ্যমে পূজা করুন: তিলের ধূপ ও হোম প্রদান করলে পরিবেশ শুদ্ধ হয় এবং পুণ্য লাভ হয়। এটি আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনেও সহায়ক।
উপসংহার
ষটতিলা একাদশী হলো পুণ্যের অমৃত সঞ্চয়ের এক বিশেষ দিন, যা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই একাদশী পালনের মাধ্যমে মানুষ পাপ মুক্তি লাভ করে, পুণ্যের সঞ্চয় করে এবং দেহ, মন ও আত্মাকে পবিত্র করে। তাই, ষটতিলা একাদশী পালনের মাধ্যমে আমরা নিজেদের জীবনে পুণ্য সঞ্চয় করতে পারি এবং পরলোক গমনের পর স্বর্গে সুখ ও সমৃদ্ধি ভোগ করতে পারি।
এই একাদশী পালন করলে ভগবান বিষ্ণুর আশীর্বাদ লাভ করা যায় এবং জীবনে শান্তি ও সমৃদ্ধি আসে। তাই, আসুন আমরা সবাই ষটতিলা একাদশীর উপবাস পালন করি এবং পুণ্যের অমৃত সঞ্চয় করি।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন