মহাভারত ভারতীয় ধর্ম, দর্শন এবং নীতির এক অনন্য গ্রন্থ। এই মহাকাব্য শুধুমাত্র যুদ্ধের কাহিনীই নয়, এতে জীবনযাপনের নানা দিক নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা রয়েছে। মহাভারতের কেন্দ্রীয় চরিত্র শ্রীকৃষ্ণ, যিনি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে পাণ্ডবদের সাথে ছিলেন। তাঁর মুখ থেকে বের হওয়া গীতার বাণীগুলি মানুষের জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য এখনও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।

মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণ

শ্রীকৃষ্ণের বাণী ও গীতার ভূমিকা

গীতা মহাভারতের একটি অঙ্গ, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে ধর্ম, কর্ম এবং জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে শিক্ষা দেন। যুদ্ধের ময়দানে যখন অর্জুন যুদ্ধ করতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়, তখন শ্রীকৃষ্ণ তাকে আত্মার অমরত্ব, কর্মের গুরুত্ব এবং নিষ্কাম কর্মযোগের উপদেশ দেন। এই বাণীগুলি শুধুমাত্র অর্জুনের জন্য নয়, বরং প্রতিটি মানুষের জীবনের দিশা দেখায়।

কর্ম ও ধর্মের সম্পর্ক

শ্রীকৃষ্ণের মতে, কর্ম করা আমাদের জীবনের প্রধান ধর্ম। তিনি বলেন, "কর্মণ্যে বাধিকরাস্তে মা ফলেষু কদাচন।" অর্থাৎ, আমাদের অধিকার শুধু কর্ম করার ওপর, কিন্তু তার ফলের ওপর নয়। আমাদের কাজ হচ্ছে নিষ্ঠার সাথে কর্ম করা, ফল নিয়ে চিন্তা না করে। এই বাণী আমাদের শেখায় যে জীবনে সবসময় নিজের কাজের প্রতি মনোযোগী হওয়া উচিত, ফল নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে।

নিষ্কাম কর্ম ও যোগের উপদেশ

শ্রীকৃষ্ণের বাণীতে যোগের গুরুত্বও তুলে ধরা হয়েছে। তিনি বলেন, "যোগ: কর্মসু কৌশলম্" অর্থাৎ যোগ হলো কর্মের নিপুণতা। এই নিপুণতা অর্জনের জন্য আমাদের কর্ম করতে হবে নিষ্কামভাবে, অর্থাৎ কোনও প্রত্যাশা ছাড়াই। তিনি আরও বলেন, "যত স্নেহ ত্যাগ করিবে, ততই সুখ লাভ করিবে।" জীবনের আসল সুখ ও শান্তি লাভ করতে হলে আমাদের নিজেদের ইচ্ছা ও কামনা ত্যাগ করে কর্ম করতে হবে।

আত্মার অমরত্ব ও মৃত্যুভয়

শ্রীকৃষ্ণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বাণী হলো আত্মার অমরত্ব। তিনি বলেন, "ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিৎ।" আত্মা কখনও জন্মায় না, কখনও মরে না। শরীর পরিবর্তন করে আত্মা যেমন নতুন পোশাক ধারণ করে, তেমনই মৃত্যুর পরও আত্মা অমর থাকে। এই বাণী আমাদের মৃত্যুভয় কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে এবং জীবনের প্রতি একটি ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তোলে।

মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণের বাণীর প্রাসঙ্গিকতা

আজকের জটিল জীবনে শ্রীকৃষ্ণের বাণী আমাদের মানসিক শান্তি ও আত্মবিশ্বাস অর্জনে সাহায্য করে। কর্ম, নিষ্কামতা, ধর্ম এবং আত্মার অমরত্বের এই বাণীগুলি আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। এগুলি আমাদের জীবনে আলোর দিশারী হিসেবে কাজ করে এবং সঠিক পথে পরিচালিত করে।

শ্রীকৃষ্ণের বাণীর বিভিন্ন দিক ও তাৎপর্য

শ্রীকৃষ্ণের বাণীগুলি শুধু ধর্ম এবং কর্মের ওপর ভিত্তি করেই সীমাবদ্ধ নয়। এগুলিতে মানব জীবনের বিভিন্ন দিকের প্রতিফলন রয়েছে। গীতার বাণীগুলি প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনে প্রভাব বিস্তার করে, যা আমরা নিচের অংশে বিশদে আলোচনা করবো।

জ্ঞান ও জ্ঞানযোগ

শ্রীকৃষ্ণ গীতায় জ্ঞানের গুরুত্ব সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, "ন হি জ্ঞানেন সদৃশম্।" জ্ঞান হলো মুক্তির পথ। প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করাই মানুষের জীবনধর্ম। শ্রীকৃষ্ণ বলেন, আত্মজ্ঞান এবং ব্রহ্মজ্ঞান অর্জন করলে মানুষ সব ধরনের ভয় এবং মায়া থেকে মুক্তি পেতে পারে। এই জ্ঞানই মানুষকে সঠিক ও ভুলের পার্থক্য করতে শেখায় এবং তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করে।

ভক্তি ও ভক্তিযোগ

শ্রীকৃষ্ণ ভক্তিযোগের ওপরও গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেছেন, "সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামে একং শরণং ব্রজ।" সমস্ত ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে কেবল শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হওয়াই হল ভক্তির সেরা রূপ। শ্রীকৃষ্ণের এই বাণী মানুষকে নিজের ভক্তি ও বিশ্বাসের প্রতি দৃঢ় থাকতে শেখায়। জীবনের কঠিন সময়ে ভগবানের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করলে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব।

ধর্ম ও ধর্মযোগ

ধর্ম হলো জীবনের মূল ভিত্তি, আর ধর্মের সঙ্গে কোনো আপস করা উচিত নয়। শ্রীকৃষ্ণ বলেন, "ধর্মক্ষেত্রে যুদ্ধ ধর্ম অনুযায়ীই হওয়া উচিত।" ধর্মের পথে থেকে আমাদের জীবন পরিচালনা করতে হবে। শ্রীকৃষ্ণের মতে, ধর্মের পথে থাকার অর্থ হলো সৎ এবং ন্যায়ের পথে থাকা, যা একদিন আমাদের জীবনের সমস্ত দুঃখ-কষ্ট দূর করবে এবং সত্যের পথ দেখাবে।

সমতা ও সাম্যবাদের শিক্ষা

গীতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বাণী হলো সমতা। শ্রীকৃষ্ণ বলেন, "সর্বত্র সমদর্শনা।" মানে, আমাদের সকলের প্রতি সমানভাবে আচরণ করা উচিত। মানুষ জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার প্রতি সমানভাবে আচরণ করলে সমাজে শান্তি এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে। শ্রীকৃষ্ণের এই সমতার বাণী মানুষকে ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে একতায় বিশ্বাসী হতে শেখায়।

দুঃখ ও সুখের সংজ্ঞা

শ্রীকৃষ্ণ জীবনের দুঃখ এবং সুখ সম্পর্কে একটি গভীর বাণী দিয়েছেন। তিনি বলেন, "দুঃখে অনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখে বিকৃতস্পৃহঃ।" জীবনে দুঃখ আসলে আমরা ভেঙে পড়ি না, এবং সুখে আমাদের মনে অহংকার না আসে। এই বাণী আমাদের শেখায় জীবনের উত্থান-পতনের মধ্যেও মানসিক শান্তি বজায় রাখতে। সুখ এবং দুঃখ উভয়ই জীবনের অংশ, এবং এগুলি মেনে নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

শ্রীকৃষ্ণের বাণীর আধুনিক প্রাসঙ্গিকতা

শ্রীকৃষ্ণের বাণীগুলি শুধুমাত্র মহাভারতের সময়কালে প্রাসঙ্গিক ছিল না, বরং আজকের আধুনিক জীবনেও এটি সমানভাবে প্রযোজ্য। বর্তমান সমাজের জটিলতায়, যখন মানুষ জীবনের লক্ষ্য হারিয়ে ফেলে, তখন শ্রীকৃষ্ণের এই বাণীগুলি তাকে সঠিক পথের সন্ধান দেয়। কর্ম, জ্ঞান, ভক্তি এবং ধর্মের এই মূল শিক্ষাগুলি আমাদের জীবনে আলোর দিশা দেখায় এবং জীবনের সকল বাধা অতিক্রম করার জন্য শক্তি যোগায়।

উপসংহার

মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণের বাণী আজও মানুষের জীবনে পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে। তাঁর দেওয়া শিক্ষা ও উপদেশ জীবনের যে কোনও সমস্যার সমাধানে প্রয়োজনীয় দিশা দেখায়। এই বাণীগুলি আমাদের জীবনের প্রতিটি স্তরে একটি স্থিতিশীলতা এবং আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে সাহায্য করে, যা আমাদের সাফল্যের পথে নিয়ে যায়।


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন