হিন্দু ধর্ম একটি প্রাচীন ধর্ম যেখানে আধ্যাত্মিকতা, দর্শন, এবং আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য ও ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা করা হয়। এই ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল মূর্তি পূজা। তবে অনেকের মনেই প্রশ্ন ওঠে, হিন্দু ধর্মে মূর্তি পূজা কেন করা হয়? মূর্তি পূজা সম্পর্কে গীতা ও বেদ কি বলে? আজ এই বিষয়ে বিস্তারিত ধারনা দেয়ার চেষ্টা করব।
মূর্তি পূজার ধারণা
মূর্তি পূজা হল এমন একটি প্রথা যেখানে একটি নির্দিষ্ট প্রতিমার মাধ্যমে ঈশ্বরের পূজা করা হয়। হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস করা হয় যে ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান এবং সমস্ত জীবের মধ্যে আছেন। কিন্তু ঈশ্বরের এই সর্বব্যাপী রূপকে উপলব্ধি করা বা চিন্তা করা অনেকের পক্ষে কঠিন। তাই মূর্তি বা প্রতিমা একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করে, যা মানুষের মনোযোগ ও ভক্তিকে কেন্দ্রীভূত করতে সাহায্য করে। মূর্তি পূজা আসলে ঈশ্বরের প্রতি গভীর ভক্তি ও শ্রদ্ধার প্রকাশ।
গীতার দৃষ্টিকোণ
"ভগবদ্গীতা" হিন্দু ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মগ্রন্থ, যেখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে ধর্ম ও জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে শিক্ষা দিয়েছেন। গীতায় মূর্তি পূজার বিষয়ে সরাসরি কোনো আলোচনা নেই, তবে ঈশ্বরের সর্বব্যাপী রূপ সম্পর্কে বলা হয়েছে।
গীতার নবম অধ্যায়ে ভগবান কৃষ্ণ বলেছেন:
"যে ব্যক্তি যে রূপে আমার আরাধনা করে, আমি তাকে সেই রূপেই সম্মান করি।" (গীতা ৯.২২)
এটি থেকে বোঝা যায়, ঈশ্বর ভক্তির ধরন বা মাধ্যম নিয়ে চিন্তা করেন না। মূর্তি পূজা সেই ভক্তির একটি রূপ, যা মানুষকে ঈশ্বরের কাছাকাছি নিয়ে যেতে সাহায্য করে। গীতার মতে, মন থেকে ভক্তি ও বিশ্বাসই আসল।
বেদের দৃষ্টিকোণ
বেদ, হিন্দু ধর্মের প্রাচীনতম গ্রন্থ, মূর্তি পূজা নিয়ে সরাসরি কোনো নির্দেশনা দেয় না। তবে বেদে ঈশ্বরের নিরাকার রূপের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ঋগ্বেদে বলা হয়েছে:
"একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি।" (ঋগ্বেদ ১.১৬৪.৪৬)
অর্থাৎ, সত্য একটিই, কিন্তু জ্ঞানীরা তাকে বিভিন্ন নামে ডাকে। এটি দেখায় যে, ঈশ্বরের উপাসনার বিভিন্ন পদ্ধতি থাকতে পারে।
বেদের মতে, ঈশ্বরের রূপ নিরাকার হলেও মানুষ তার ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রকাশের জন্য নির্দিষ্ট প্রতীক বা মূর্তি ব্যবহার করতে পারে। প্রতীক ব্যবহার করা মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য। যেমন, একটি পতাকা একটি দেশের প্রতিনিধিত্ব করে, তেমনি একটি মূর্তি ঈশ্বরের উপস্থিতি বুঝাতে ব্যবহৃত হয়।
মূর্তি পূজার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দিক
মূর্তি পূজা মূলত আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক উভয় দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দু ধর্মে প্রতিটি দেব-দেবতার বিশেষ একটি রূপ বা প্রতীক আছে। এই প্রতীকগুলির মাধ্যমে মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিক চেতনা জাগ্রত হয়। উদাহরণস্বরূপ, সরস্বতী দেবীর মূর্তি শিক্ষা ও জ্ঞানের প্রতীক, লক্ষ্মী দেবী ধন-সম্পদের প্রতীক।
প্রাচীন ভারতীয় সমাজে মন্দির স্থাপত্য ও মূর্তি নির্মাণ ছিল একটি উচ্চতর শিল্প। মূর্তির মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা এবং ভক্তির প্রকাশ ঘটানো সহজ হয়েছিল।
সমাপ্তি
হিন্দু ধর্মে মূর্তি পূজা একটি গুরুত্বপূর্ণ আচার যা মানুষের আধ্যাত্মিক যাত্রাকে সহজ ও মননশীল করে তোলে। গীতা ও বেদে মূর্তি পূজার পক্ষে বা বিপক্ষে সরাসরি কিছু না বলা হলেও, ঈশ্বরের সর্বব্যাপী রূপ এবং ভক্তির গুরুত্বের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
অতএব, মূর্তি পূজাকে শুধুমাত্র একটি আচার হিসেবে নয়, বরং ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের একটি মাধ্যম হিসেবে দেখা উচিত। ঈশ্বর যেহেতু সর্বত্র বিরাজমান, তাই মূর্তি কেবলমাত্র সেই চেতনার এক রূপ যা আমাদের বিশ্বাস এবং ভক্তিকে দৃঢ় করে।
আরও পড়ুন: হিন্দু ধর্ম কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে? হিন্দু ধর্মের প্রধান স্রষ্টা বা ভগবান কে?
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন