দেবী কালী, যিনি হিন্দুধর্মে শক্তি এবং সংহার শক্তির প্রতীক, তার সৃষ্টি কাহিনী অত্যন্ত রহস্যময় এবং তাৎপর্যপূর্ণ। মা কালীর রূপ এবং তার সৃষ্টি নিয়ে নানা পুরাণ এবং শাস্ত্রে বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়।
অসুরদের তাণ্ডব
কথিত আছে, একসময় পৃথিবী অসুরদের অত্যাচারে পূর্ণ হয়ে ওঠে। তারা দেবতাদের শাসন এবং মানব জাতির শান্তি বিঘ্নিত করছিল। অসুর রাজা শুম্ভ-নিশুম্ভ, চণ্ড-মুণ্ড এবং রক্তবীজ নামে অসুরেরা তাদের অদম্য শক্তি দিয়ে দেবতাদের পরাজিত করে স্বর্গ অধিকার করে। দেবতারা অসহায় হয়ে মা আদ্যাশক্তি দুর্গার শরণাপন্ন হন। দেবতাদের আর্তি শুনে মা দুর্গা প্রতিজ্ঞা করেন যে তিনি অসুরদের বিনাশ করবেন।
দেবী কালীর উদ্ভব
যুদ্ধ শুরু হলে মা দুর্গা তার সমস্ত শক্তি নিয়ে অসুরদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। চণ্ড এবং মুণ্ড নামে দুই অসুরকে দমন করার জন্য মা দুর্গার ভ্রূকুটি থেকে উদ্ভূত হন দেবী কালী। কালো বর্ণের, দীর্ঘ জিহ্বা এবং ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে তিনি প্রकट হন। তার চার হাতে ছিল খড়গ, ত্রিশূল এবং কাটা মুণ্ড। চণ্ড-মুণ্ডকে বিনাশ করার পর দেবী দুর্গা তাকে আশীর্বাদ দিয়ে "চামুণ্ডা" নামে অভিহিত করেন।
রক্তবীজের বিনাশ
এরপর আসেন রক্তবীজ, এক ভয়ঙ্কর অসুর। রক্তবীজের বিশেষ ক্ষমতা ছিল যে, তার শরীর থেকে প্রতিটি রক্তবিন্দু পড়লেই সেই রক্ত থেকে আরেকটি নতুন রক্তবীজ জন্ম নিত। তাকে বধ করা প্রায় অসম্ভব ছিল। তখন দেবী কালী তার রুদ্র রূপ ধারণ করেন। তিনি রক্তবীজের শরীর থেকে রক্ত চুষে নিয়ে তাকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করেন। দেবী কালী তার নৃত্যের মাধ্যমে অসুরদের সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করেন এবং বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
দেবী কালীর ভয়ঙ্কর নৃত্য
দেবী কালী যখন অসুরদের বিনাশ করছেন, তখন তার ক্রোধ এতই বৃদ্ধি পায় যে তিনি ধ্বংসাত্মক নৃত্য শুরু করেন। তার এই নৃত্যের ফলে সমগ্র পৃথিবী কাঁপতে থাকে। দেবতারা ভীত হয়ে মহাদেব শিবের শরণাপন্ন হন। শিব দেবী কালীর সামনে শুয়ে পড়েন। দেবী কালী যখন শিবের উপর পদার্পণ করেন, তখন তিনি নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং শান্ত হন। এই ঘটনা দেবী কালীর করুণাময় রূপের পরিচয় দেয়।
দেবী কালীর তাৎপর্য
মা কালী শুধু সংহারের দেবী নন, তিনি মাতৃত্ব এবং সুরক্ষার প্রতীক। তার রূপ ভয়ঙ্কর হলেও তিনি তার ভক্তদের প্রতি অত্যন্ত করুণাময়। তিনি অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাওয়ার পথ দেখান এবং সকল বাধা অতিক্রম করার সাহস দেন।
আরও পড়ুনঃ মা কালীর গলায় মুণ্ডমালা কেন? মা কালী কেন মুন্ডমালা পরেন?
দেবী কালীর পূজা ও উপাসনা
মা কালীর উপাসনা সাধারণত গভীর রাতে করা হয়। তার পূজায় নিবেদিত হয় লাল ফুল, প্রদীপ, ধূপ এবং কখনো কখনো পশু বলির মাধ্যমে ভক্তরা তাকে তুষ্ট করার চেষ্টা করেন। বিশেষত, কালীপূজার দিন ভক্তরা উপবাস থেকে শুরু করে সারারাত জাগরণ করেন। দেবীর মন্দিরে ঢোল-তবলার সঙ্গে চণ্ডীপাঠ এবং সংকীর্তন পরিবেশিত হয়। মা কালী তার ভক্তদের ইচ্ছা পূরণ করেন এবং তাদের সব বিপদ থেকে রক্ষা করেন।
দেবী কালীর জনপ্রিয়তা
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা এবং আসামের মতো রাজ্যগুলিতে মা কালীর পূজা অত্যন্ত জনপ্রিয়। কলকাতার বিখ্যাত দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির এবং কালীঘাট মন্দিরে লক্ষ লক্ষ ভক্ত প্রতিদিন দেবীকে দর্শন করতে আসেন। কালীপূজা এবং দীপাবলির সময় এই স্থানগুলোতে এক বিশেষ উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়।
মা কালীর আধুনিক প্রভাব
আধুনিক যুগেও মা কালী ভক্তদের মধ্যে এক অপরিহার্য প্রেরণার উৎস। তার রূপ এবং উপাসনা শুধু ধর্মীয় ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সাহিত্যে, চিত্রকলা, সঙ্গীত এবং সিনেমায়ও তিনি এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছেন। তার রূপ আমাদের শেখায় যে, শক্তি এবং মমত্ববোধ একসঙ্গে অবস্থান করতে পারে।
মা কালীর সৃষ্টি কাহিনী আমাদের জীবনের অন্ধকার সময়ে আলোর পথ দেখানোর প্রতীক। তিনি সকল প্রতিকূলতা অতিক্রম করে বিজয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা জোগান।
আরও পড়ুনঃ হিন্দু ধর্ম কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে? হিন্দু ধর্মের প্রধান স্রষ্টা বা ভগবান কে?
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন