মহাকবি কালিদাস রচিত "মেঘদূত" সংস্কৃত সাহিত্যের এক অমর কাব্য। এই কাব্যের মূল উপজীব্য এক নির্বাসিত যক্ষের বেদনাভরা হৃদয় আর তার প্রিয়তমাকে চিঠি পৌঁছে দেওয়ার জন্য মেঘের কাছে অনুরোধ। কাব্যে যক্ষ মেঘকে বার্তাবাহক হিসেবে কল্পনা করে তার প্রেয়সীর কাছে বার্তা পৌঁছানোর জন্য এক মনোমুগ্ধকর যাত্রাপথের নির্দেশনা দেয়। এই পথ যেন প্রকৃতির সৌন্দর্য ও ভারতীয় ভৌগোলিক বৈচিত্র্যের এক অনুপম চিত্র!

মেঘদূত

মেঘের যাত্রার সূচনা: রামগিরি পর্বত

যক্ষ আলকাপুরী থেকে নির্বাসিত হয়ে রামগিরি পর্বতে আশ্রয় নেয়। তার ব্যথাতুর হৃদয়ে জন্ম নেয় এক অসাধারণ কল্পনা—যদি মেঘকে দূতের ভূমিকা দেওয়া যায়, তবে সে তার প্রিয়তমাকে বার্তা পৌঁছে দিতে পারবে। তাই সে মেঘকে অনুরোধ করে উত্তরমুখী হতে, কারণ তার প্রেয়সী বাস করে দূরের অলকানগরে।

উজ্জয়িনীর রাজকীয় সৌন্দর্য

মেঘ প্রথমে উজ্জয়িনী শহরের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এটি ছিল সেই সময়ের অন্যতম সমৃদ্ধ নগরী। কবির বর্ণনায় উজ্জয়িনী এক রাজকীয় শহর, যেখানে নর্তকীদের নৃত্য, সুগন্ধি ফুলের বাগান, এবং রাজপ্রাসাদের জাঁকজমকপূর্ণ চিত্র ফুটে ওঠে। মেঘের পথচলার সঙ্গে সঙ্গে সেই নগরীর সংস্কৃতি, জনজীবন ও সৌন্দর্য আরও রঙিন হয়ে ওঠে।

মালবদেশ ও বিন্ধ্যপর্বতের শোভা

উজ্জয়িনী পেরিয়ে মেঘ মালবদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এখানে বিস্তৃত শস্যক্ষেত্র ও নদীর স্নিগ্ধ ধারা কবির বর্ণনায় এক অপূর্ব প্রকৃতির ছবি তুলে ধরে। এরপর মেঘ এসে পৌঁছায় বিন্ধ্যপর্বতের ওপরে, যেখানে ধূপগন্ধী বনভূমি, পশুপাখির কোলাহল আর পর্বতের গম্ভীর নীরবতা এক অভূতপূর্ব পরিবেশ সৃষ্টি করে।

গঙ্গার তীরে বারাণসী

মেঘ বিন্ধ্যপর্বত অতিক্রম করে বারাণসীর দিকে অগ্রসর হয়। বারাণসী তখনকার সময়ে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষার অন্যতম কেন্দ্রস্থল ছিল। গঙ্গার স্রোতধারার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে হতে মেঘ এই শহরের পবিত্রতার সাক্ষী হয়ে ওঠে।

হিমালয়ের সৌন্দর্য ও কৈলাস শৃঙ্গ

এরপর মেঘ চলে আসে হিমালয়ের দিকে। এখানে বরফে ঢাকা শৃঙ্গ, দূর্গম গিরিপথ, এবং প্রকৃতির অপরূপ শোভা কবির কল্পনায় এক স্বপ্নের রাজ্য হয়ে ওঠে। হিমালয়ের বিশালতা ও শান্ত সৌন্দর্য যেন প্রকৃতির অপরূপ রহস্যময়তার প্রতীক। মেঘ এই পর্বতের উপর দিয়ে ভেসে কৈলাস শৃঙ্গের কাছে পৌঁছায়, যেখানে মহাদেবের বাস।

অলকানগর: যক্ষের প্রেয়সীর ঠিকানা

অবশেষে মেঘ অলকানগরে পৌঁছে যায়। এটি ছিল কুবেরের রাজধানী, যেখানে যক্ষের প্রিয়তমা বসবাস করতেন। অলকানগরের সৌন্দর্য যেন এক স্বর্গীয় নগরীর প্রতিচ্ছবি। এখানে দেবতা ও গন্ধর্বদের নৃত্যগীত, বাগানের সুগন্ধি, এবং চন্দ্রালোকে ভিজে থাকা পথ কবির কল্পনায় এক স্বপ্নময় পরিবেশ তৈরি করে।

উপসংহার

মেঘদূত কেবল একটি প্রেমকাব্য নয়, এটি প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের এক মহাকাব্যিক বর্ণনা। মেঘের এই যাত্রাপথে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল, নগরী, নদী, পর্বত, বনভূমি এক অবিস্মরণীয় ভ্রমণের রূপ পেয়েছে। প্রকৃতি ও প্রেমের এক অসাধারণ সংমিশ্রণে কালিদাস তার "মেঘদূত" কাব্যকে চিরকালীন সৌন্দর্যের প্রতীক করে তুলেছেন।

আরও পড়ুন : কান্ডারী হুশিয়ার কবিতার মূলভাব ও বিষয়বস্তু

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন